দেশজুড়ে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারের দৌরাত্ম্য এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। বিভিন্ন বাহারি ডিগ্রি সংবলিত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করছেন তারা। ফলে চিকিৎসাসেবায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন। গত জুন পর্যন্ত দুই বছরে সারা দেশে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া ডাক্তারের কবলে পড়ে সাড়ে চার শতাধিক রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের ভুল ও গাফিলতিতে ৬৭ জন এবং ঢাকার বাইরে আরও প্রায় ৪০০ রোগী মারা যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তাদের ভুল চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়েছে, অল্প সময়েই নিভে গেছে তাদের জীবন প্রদীপ।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) হিসেবে শুধু রাজধানীতেই আড়াই সহস াধিক ভুয়া ডাক্তার রয়েছে, সারা দেশে এ সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। তবে বাস্তবে বিএমডিসির দেওয়া পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি ভুয়া ডাক্তার দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ভুয়া ডাক্তারের পাশাপাশি জাল ডিগ্রীধারী ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের’ সংখ্যাও কম নয়। তারা এমবিবিএস পাসের পর নামের আগে পিছে দেশ-বিদেশের ভুয়া উচ্চতর ডিগ্রি ব্যবহার করে বছরের পর বছর রোগী দেখছেন, হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের ফি।
ভুয়া ডাক্তার-দালালদের দৌরাত্ম্য, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা আর চিকিৎসা বাণিজ্যের নির্মমতায় একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের উদ্যোগে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অর্ধ শতাধিক ভুয়া ডাক্তারকে আটক এবং তাদের জেল-জরিমানা করা হয়। ভুয়া ডিগ্রীধারী চিকিৎসকদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের কথা স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসা সেক্টরে ভুয়া ডাক্তার ও অপচিকিৎসা ব্যবস্থাটি বছরের পর বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতোই চেপে আছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার লক্ষ্যে বিএমডিসি ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।
ভুল চিকিৎসার নির্মম বলি হয়েছে সাংবাদিক রুবেলের দুই বছর বয়সী মেয়ে রাইফা। ঠাণ্ডাজনিত সামান্য সমস্যা থেকে হাসপাতালে ভর্তি। এরপর ডাক্তার-নার্সের হেয়ালি ইনজেকশন কেড়ে নিল আড়াই বছরের ফুটফুটে মেয়েটিকে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে হাতুড়ে ডাক্তার হয়েও সাইনবোর্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয়ে রাজধানীসহ সর্বত্রই প্রতারণা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মেসিতে মোবাইল কোর্টের অভিযানকালেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয়ধারী ৩১ জনকে আটকের ঘটনাও ঘটে। শতকরা ৯০ ভাগ ভুয়া ডিগ্রীধারী ডাক্তার দ্বারাই বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-নার্সিং হোমের চিকিৎসাসেবা পরিচালিত হচ্ছে। বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভুয়া ডাক্তাররা নামের পেছনে এফআরএসএইচ, এমএসিপি, এফআরসিপি, পিজিটি, এমডি ও এফসিপিএস (ইনকোর্স) ও পার্ট-১ অথবা পার্ট-২সহ বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করে। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামও উল্লেখ করা হয়। এ কারণে সাধারণ রোগীরা এসব ডাক্তারকে বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে মনে করেন। এ সুযোগে ভুয়া ডাক্তাররা রোগীপ্রতি ফি নেন পাঁচশ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।
দেশে ভুয়া ডিগ্রির অভাব নেই, টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের জাল সনদপত্র। এটাও অজ্ঞ-অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে দৃষ্টান্ত রাখছে বলে মনে করছেন বিএমডিসি কর্তৃপক্ষ। সামান্য কিছু টাকা খরচ করলেই যে কেউ হতে পারেন সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ডাক্তার। পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকলেও চলবে। খরচের পরিমাণও নাগালের মধ্যেই। ভারত বা অন্য দেশের সার্টিফিকেট পেতে ১৫/২০ হাজার টাকা খরচ করলেই হয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঘেঁষা এলাকা থেকে এসব সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে সব মিলিয়ে ৫/৬ হাজার টাকা লাগে। ডেন্টাল কলেজের সার্টিফিকেটের জন্য চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা হলেই চলবে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্টিফিকেট পেতে হলে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা গুনতে হয়।